Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কলকাতা থেকে

পূর্ণ যৌবনে

রজত জয়ন্তী উৎসবে যুগান্তর

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পূর্ণ যৌবনে

ছাব্বিশে পা দিল যুগান্তর, তার মানে এ পত্রিকা এখন আয়ুষ্কালের এক ভিন্ন হিসাবে পৌঁছাল, আর সে বছর বছর গুনবে না এক-এক করে। আমরা গত বছরই জানিয়েছিলাম যে সে এবার ‘দামি’ জয়ন্তীর হিসাবে পৌঁছে গেছে। উদ্যাপন করছে রজতজয়ন্তীর উৎসব। এরপর সুবর্ণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী, প্লাটিনামজয়ন্তী প্রভৃতি সার বেঁধে তোরণ সাজিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে। সে সুনিশ্চিত পদক্ষেপে একে একে ওই তোরণগুলোও পার হবে।

এই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া জয়ন্তীর হিসাব ছেড়ে বছরের হিসাবে এসে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। পঁচিশ বছর হলো যৌবনের পরিপক্ব সময়। যুগান্তর সেই বয়স পেরিয়েছে বলে তাকে প্রচুর অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এখানেও মানবজীবনের সঙ্গে তার তুলনা চলবে না। আমরা আগেও বলেছি, খবরের কাগজকে যুবক হয়েই জন্মাতে হয়, কারণ তাকে দৌড়াতে হয় তার অগ্রজদের সঙ্গে, তার চেয়ে পঞ্চাশ-ষাট-একশ বছর আগে জন্মেছে এমন দৈনিক কাগজের সঙ্গে। যৌবন নিয়েই জন্মাতে হয়, এবং আজীবন যৌবনকে ধরে রাখতে হবে, যেমন করে হোক। চিত্রতারকাদের মতো ওষুধ-বিষুধ মালিশ আর প্লাস্টিক সার্জারির আপ্রাণ করুণ চেষ্টায় নয়; নিজের জোরে, শ্রমে, উদ্যমে। আর আমরা তো বাস করি একেবারেই বাস্তব পৃথিবীতে, কালীদাসের অলকাপুরীতে নয়, কাজেই এখানে পরিবেশের বদান্যতায় ‘বয়ো যৌবনাদ্ নান্যস্তি’ (‘যৌবন ছাড়া অন্য বয়স নেই’)-এমন হওয়ার কোনো উপায় গরহাজির। কাজেই জয়ন্তী আসুক একটার পর একটা, মানুষের মতো কোনো কাগজের প্রৌঢ়, প্রবীণ, বৃদ্ধ হলে চলবে না। খবরের কাগজের হাতে সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’র উদো-বুধো দুই বুড়োর সেই যাদুক্ষমতাও নেই যে, বয়স এক দুই তিন করে কিছু দূর ওঠার পর আবার তাদের বয়স কমতে শুরু করবে-পঁচিশ, চব্বিশ, তেইশ করে নিচের দিকে। তাকে দুর্ধর্ষ যৌবনের ফ্রেমের মধ্যে নিজেকে অনন্তকাল আটকে রাখতে হবে।

এসব কথা থাক। শুধু বেঁচে থাকাতেই তো কাগজের সার্থকতা নয়, তাকে অন্তত পাঠকের কাছে নিজের স্বাতন্ত্র্যে অপরিহার্য হয়ে উঠতে হবে। নইলে অন্য কাগজ ছেড়ে সে কাগজ লোকে কিনবে কেন? যে লোক দুটি বা তিনটি কাগজ কেনে, সে আমার প্রিয় কাগজকেই বা কিনবে কেন? এমন হতেই পারে যে, যুগান্তর লাখ লাখ লোকের প্রথম পছন্দ, আবার বেশকিছু লোকের দ্বিতীয় পছন্দ। এই মানুষের পছন্দের বৃত্তে পৌঁছোনোর জন্যই সে এতদিন উজ্জীবিত তরুণের মতো লড়াই করে এসেছে, নিজের একটি বড় জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। আমরা চাই যুগান্তর শুধু নিজের জায়গা বজায় রাখবে তাই নয়, সে আরও অজস্র সংবাদপত্র পাঠকের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠবে।

তবে আমাদের দম ফুরিয়ে এসেছে, অত পথ আমরা তার সঙ্গী হতে পারব না, আমাদের অনেককেই আগে দৌড় থেকে ছিটকে যেতে হবে-আমাকে তো ওই ‘অনেকের’ অনেক আগে। মানুষের আয়ু আর জনপ্রিয় সংবাদপত্রের আয়ু তো কখনোই এক হওয়ার কথা নয়। অনেক সংবাদপত্রই প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে। যুগান্তর আমার সময়ে জন্ম নিল, প্রত্যাশা করি আমার সময় পেরিয়ে আরও বহু বহু প্রজন্মকে সে ছুঁতে পারবে। এগিয়ে যাবে আরও বহু বহু প্রজন্মের দিকে। আমার মতো সবাই তার কাছে ‘ক্ষণিকের অতিথি’ হব। তবু বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে কাটল, তার আনন্দময় স্মৃতি তো আমাদের সঙ্গে রইলই।

আমি আমার আয়ুষ্কালে নানারকমের যুগান্তর দেখেছি, তার দ্বারা ওলটপালট হয়েছি। দেশবিভাগ, দাঙ্গা, বাংলাদেশের মহিমান্বিত অভ্যুদয়, সোভিয়েত দেশের অবলুপ্তি, উদার অর্থনীতির উদ্ভব, অবিশ্বাস্য নতুন প্রযুক্তির গ্রাস, নতুন নারীচেতনা-লিঙ্গচেতনার উন্মেষ, উত্তর-আধুনিকতার প্রভাবে নানা ধরনের প্রান্তিকতার কমবেশি স্বীকৃতি; আরও কত কিছু, যার পুরো হিসাবও আমি জানি না। এখন তো বাংলাদেশে আরও এক যুগান্তর ঘটে চলেছে, আমরা সবাই একটা স্থিতির প্রত্যাশা নিয়ে আছি। এসব বিশাল পরিবর্তন আমার কাছে শারীরিক ও মানসিকভাবে পৌঁছেছে প্রধানত যে মাধ্যমে, তার নাম বই ও সংবাদপত্র। কারণ আমি মূলত মুদ্রণাসক্ত জীব। এতে আমি প্রাচীনপিন্থ বলে চিহ্নিত হব, কিন্তু এই আটাশি বছর বয়সে আমার কোনোরকম বিশেষণের বা চিহ্নায়নের ভয় নেই।

অবশ্যই রেডিওর সময়ে রেডিও শুনেছি, দেশে-বিদেশে টেলিভিশনও দেখেছি। কিন্তু এখন আমার কাছে রেডিও-টেলিভিশন মাধ্যম হিসাবে মৃত ও অস্তিত্বহীন। আমি শুধু পড়ি বই আর সংবাদপত্র। পূর্ববঙ্গে আমার শৈশবে বাড়িতে ডাকযোগে কলকাতার কাগজ ‘অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকা’ আসত, সেই থেকে সংবাদপত্রে আসক্তির শুরু। এখন আমি বাড়িতে সকালে চারটি কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র রাখি, রোববারে আরও দুটি যুক্ত হয়। এ নিয়ে আমার বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করি। আর লিখি কলকাতার একাধিক কাগজে, উত্তরবঙ্গের কাগজে, শিলচরের কাগজে, ইংরেজি বাংলায় ঢাকার একাধিক কাগজে, যার মধ্যে যুগান্তর অগ্রগণ্য। অবশ্যই ঢাকার কাগজগুলো নিয়মিত দেখা সম্ভব হয় না, তবু মাঝে মাঝে আমার ডেস্কটপে বা মোবাইলে তাদের বৈদ্যুতিক সংস্করণ দেখি বৈকি। সম্পাদক বন্ধুরা লিংক দেন, তাতেও সুবিধা হয়। সকালে জলখাবারের সঙ্গে সংবাদপত্র না দেখলে আমার দিনটা বিস্বাদ যায়।

বাংলাদেশে যুগান্তর বহুদিন আগে আমাকে তাদের লেখক হিসাবে গ্রহণ করেছে, এ জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকি। এ নামটি আমাদের কৈশোরের একটি প্রিয় কলকাতার কাগজের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেটি দেশবিভাগের পরে বিশেষভাবে লোকপ্রিয় হয়েছিল, কলকাতার বিখ্যাত অমৃতবাজার গোষ্ঠীর বাংলা কাগজ ছিল সেটি।

গুগলে দেখলাম, ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীর দৈনিক সংবাদপত্র এখনো কয়েকটি বেঁচে আছে। যেমন, ইতালির ‘গেৎসেত্তা দি মান্তোবা’ (১৬৬৪-), লন্ডনের ‘অক্সফোর্ড গেজেট’ (১৬৬৬-), আর অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় (১৭০১) ভিয়েনার ‘ভিয়েনার ৎসাইটুংক্’। ‘যুগান্তর’ও এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হোক, এই শুভেচ্ছা রইল। তার অবস্থান সত্যের পক্ষে হোক, কোনো শাসক বা দলের পক্ষে নয়।

তার সাহসী ও সংগ্রামী যৌবন অনন্ত হোক।

পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম