Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

কলকাতা থেকে

আমি যে বাংলাদেশকে ভালোবাসি

রজত জয়ন্তী উৎসবে যুগান্তর

Icon

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমি যে বাংলাদেশকে ভালোবাসি

সৌমিত্র দস্তিদার।

গত বছর জুন মাসের চ্যাটচ্যাটে গরমে যখন ঢাকায় ছিলাম, তখনই ছাত্রদের কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন সবে শুরু হচ্ছিল। জুনের তখন শেষ সপ্তাহ। ঢাকার যানজট অসহ্য লাগে এটা ঠিকই, তবুও শহরটাকে আমার খারাপ লাগে না। বেশ প্রাণবন্ত। ইদানীং অবশ্য ঢাকার বন্ধুবান্ধব অভিযোগ করেন, ঢাকা এখন আর অত উচ্ছল, জীবন্ত নেই। কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। চারপাশে কত বৈষম্য, অশান্তি অথচ কোথাও কোনো হেলদোল নেই। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। একদার বিদ্রোহী ঢাকাকে আর আগের মতো খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার অবশ্য কেমন যেন মনে হতো, আপাত শান্ত ঢাকা ভেতরে ভেতরে গুমরে আছে। এ যেন কোনো মৃত আগ্নেয়গিরি। আচমকা অগ্নুৎপাতে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তখন মৃদু স্লোগান সবে উঠতে শুরু করেছে। আওয়াজ উঠছে-কোটা না মেধা, মেধা মেধা। আমি এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি। ঝকঝকে আকাশ। কোথাও কোনো মেঘের দেখা নেই। আসলে তখন বুঝতেই পারিনি মেঘ কিন্তু জমছে ঢাকার আকাশে।

জুন নিঃশব্দে অতীত হয়ে গেল। অভ্যাসমতো বাংলাদেশের খবরে চোখ রাখছি। বুঝতে পারছি ছাত্র বিক্ষোভ বাড়ছে। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার কথায় সন্তুষ্ট নন ছাত্ররা। তবুও কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকার রাজপথ যে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে, ভুলেও তা ভাবিনি। আসলে শেখ হাসিনার লৌহকঠিন শাসনেও যে ফাটল ধরতে পারে, তা আমি কেন, অনেক রথীমহারথীর কাছেই ছিল অভাবনীয়। পরবর্তী সময়ে অবশ্য মনে হয়েছে, এ গণ-অভ্যুত্থান ঘটত। হয় আগে, না হয় পরে। হাসিনা ভক্তদের অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এর পেছনে ছিল বিরাট এক ষড়যন্ত্র। জুলাইয়েও ঢাকা যখন আক্ষরিক অর্থেই জ্বলছিল, তখন আমার ইনবক্সে একের পর এক মেসেজ ঢুকছিল, আমাকে সতর্ক করতে। আমি যেন কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ফাঁদে পা না দিই। যারা লিখছিলেন, তাদের অনেকেই নিশ্চিত আমার শুভানুধ্যায়ী, আপনজন। তাদের মধ্যে ভারতীয় দূতাবাসের সাবেক আধিকারিক, ঢাকার বামপন্থি কর্মী, এমনকি বাংলাদেশের এক অভিনেত্রী অবধি ছিলেন। তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাদের দুর্ভাগ্য, ততদিনে আমি লীগের মিষ্টিমুখের আড়ালে যে বিষাক্ত মুখ, তা দেখে ফেলেছি। ফলে আওয়ামী ন্যারেটিভ থেকে আগেই দূরে সরে যাওয়ায় আমার অধিকাংশ প্রিয়জনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খুঁজে পেলাম না।

সত্যি কথা বলতে, আমি বাংলাদেশ চিনেছিলাম মওলানা ভাসানীকে নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে। ভাসানী, মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগ, কাগমারী সম্মেলন, ন্যাপের জন্ম-অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলাদেশের জন্মবৃত্তান্ত অত্যন্ত চিন্তাবর্ষক এক বিষয়। একাডেমিক দিক দিয়েও বিষয় হিসাবে বাংলাদেশ স্টাডিজ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নানা কারণেই বাংলাদেশ চর্চা মানেই হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ বা শেখ পরিবারের গুণকীর্তন। এর সঙ্গে ইতিহাসের কোথাও কোনো সম্পর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধ আদতেই ছিল জনযুদ্ধ। যেখানে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল অসংখ্য সাধারণ মানুষ। হাসিনার দলের স্লোগান ছিল কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন। তা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা অগাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠনকে বৈধতা দিয়েছিলেন। গুম খুন, যাবতীয় স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা হাসিনা রেজিমের বৈশিষ্ট্য ছিল। ফলে একদিন না একদিন মানুষ যে রুখে দাঁড়াবে, তা কয়েক বছর ধরে বুঝতে পারতাম। ২০১৮ সালে সড়ক আন্দোলনের সময়ে যেভাবে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ওপর নৃশংস অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল হাসিনা সরকার, তা আজও অনেকেই মনে রেখেছেন। কয়েক মাস আগে আমি নওশাবা বলে ঢাকার নামি অভিনেত্রীকে ইন্টারভিউ করতে গিয়ে ওর ওপর যেভাবে অত্যাচার হয়েছিল, তা শুনতে শুনতে ক্রুদ্ধ হচ্ছিলাম হাসিনা রেজিমের ওপর। মেয়েটি সড়ক আন্দোলনের সময় ছেলেমেয়েদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সামান্য এক পোস্ট দিয়েছিল বলে তাকে প্রায় এক মাস জেল খাটতে হয়েছিল। এরকম অনেক ঘটনা রয়েছে। আমি নিজে মাইকেল চাকমার কাছ থেকে ওর আয়নাঘরের অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, এও হতে পারে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশে! তাও হয়তো জুলাই মাসের ঘটনা নিয়ে মুখ খুলতাম না, যদি না আমার চেনা পরিচিত অনেকেই ফোনে কান্নাকাটি করে না বলতেন, দাদা দোয়া করবেন, আর বোধহয় বেঁচে থাকব না। কেউ বললেন, দাদা স্পিক আউট প্লিজ। আপনি তো দেশটাকে চেনেন। মুখ খুললাম। তখনো হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। তিনি মসনদ ছেড়ে দেবেন, এটা অকল্পনীয়। ফলে অনেকেই বলতে লাগলেন, আপনার আর কখনো ওপারে যাওয়া হবে না। মনে মনে বললাম, কী আর করা যাবে! তবুও চরম অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেই হবে।

এরপরের ঘটনা তো সবাই জানেন। কীভাবে, কোন পরিস্থিতিতে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো। প্রধান হলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সময় থেকে তিন তিনবার বাংলাদেশে গেছি। অনেক বদল দেখেছি। সব থেকে বড় পরিবর্তন, বহু বিষয়ে মানুষ মুখ খুলছেন। যেভাবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা সত্য বলে মনে হয়নি। বাংলাদেশ তালেবান রাষ্ট্র হয়ে গেছে, তা কখনো মনে হয়নি। যতটুকু জানি, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মান্ধ নন। আতিথেয়তায় তাদের জুড়ি নেই। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি নিশ্চিত জিতবে, দেশের নব্বই শতাংশ লোক তা বিশ্বাস করেন। জুলাই অভ্যুত্থান দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ঐক্য গড়তে পেরেছিল, তাতে ফাটল ধরেছে, মনে হয়। বিভিন্ন দল তাদের নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগোতে চাইছে। ছাত্র-জনতাও সম্ভবত নতুন দল গড়তে চলেছেন। তবে আমরা যারা বিদেশি, তারা প্রায় সবাই একমত, মোটের ওপর সারা দেশে সাংগঠনিক দিক দিয়েও বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি হচ্ছে বামের ডান আর ডানের বাম। লিবারেল সেন্ট্রিস্ট দল। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সাধারণভাবে মধ্যপন্থাকেই পছন্দ করেন। ফলে সেক্ষেত্রে বিএনপি আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে, এটা ধরে নেওয়া যায়।

সৌমিত্র দস্তিদার : সাংবাদিক, গবেষক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম