Logo
Logo
×

যুগান্তর বর্ষপূর্তি

মুক্তির মন্দির সোপান তলে

Icon

ড. মাহবুব উল্লাহ

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৮ এএম

মুক্তির মন্দির সোপান তলে

ড. মাহবুব উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার যে গণ-অভ্যুত্থান হলো, তা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমাদের এই ভূখণ্ডে অতীতে বেশ কবার ছোট-বড় গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার পর ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান এদেশের গণ-অভ্যুত্থানের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। 

সাদামাটাভাবে দেখলে দেখা যাবে, মোটা দাগে ১০ বছর বা এর চেয়ে কমবেশি ব্যবধানে গণ-অভ্যুত্থানগুলো হয়েছে। তাহলে কি বলা যায়, আমাদের এদেশে গণ-অভ্যুত্থানের একটি চক্রাকার প্যাটার্ন রয়েছে? অর্থাৎ ঘুরেফিরে আমরা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলি। এর ফলে কখনো শাসকের পরিবর্তন হয়েছে, আবার কখনো হয়নি। ’৫২-এর ভাষা-আন্দোলনের ফলে ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ থেকে মুসলিম লীগ উচ্ছেদ হয়ে গেল। 

এরপর থেকে এদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগ তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। ১৯৬২-তে দুই দফায় ছাত্রদের নেতৃত্বে আইয়ুব শাসনবিরোধী এবং আইয়ুবের করা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। আইয়ুবি সামরিক শাসনের চার বছরের মাথায় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা শহরের হাট-বাজার ও দোকানে টাঙিয়ে রাখা আইয়ুব খানের বাঁধাই করা ফটো ছাত্র বিক্ষোভকারীরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, এত কিছু থাকতে আইয়ুব খানের ছবির ওপর আক্রোশ কেন? বুঝতে হবে সব অভ্যুত্থান ও বিপ্লবে অভ্যুত্থানকারী ও বিপ্লবীরা ক্ষমতাসীন শাসকের প্রতীককে লক্ষ্যবস্তু করে। এই প্রতীক চুরমার করে শাসককে চুরমার করে ফেলার সংকেত প্রদান করে আন্দোলনকারীরা। 

রাজনীতিতেও প্রতীক ব্যবহৃত হয়। উপমহাদেশের আন্দোলনে জিন্নাহর টুপি, গান্ধীর খাদি, জওহরলাল নেহেরুর জওহর কোর্ট ও মওলানা ভাসানীর তালের আঁশের টুপি জনগণের মধ্যে রাজনীতির বহুমুখী সংকেত ছড়িয়ে দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানও রাজনীতি করতে গিয়ে মুজিব কোট পরেছিলেন। তার অনুসারীরাও তাকে অনুসরণ করে কালো রঙের মুজিব কোট পরে থাকে। যদিও আমরা জানি মুজিব কোট ছিল জওহর কোটেরই পরিবর্তিত সংস্করণ। তারপরও বলা যায়, রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রতীক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

১৯৬৯-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে পল্টনের বিশাল জনসভায় ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের রাজনৈতিক দর্শন সংবলিত গ্রন্থ ‘Friends Not Masters’-এর বহ্নি উৎসব হয়েছিল। এখানেও আমরা দেখি স্বৈরশাসকের একটি প্রতীক ছাইভস্বে পরিণত হতে। ২০২৪-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের অনেক মূর্তি ও মুর্যাল ধ্বংস করা হয়েছে। এর ফলে মুজিব অনুরাগীরা ব্যথিত হয়েছেন। ব্যাপারটি নির্মম হলেও নিরর্থক ছিল না। ক্রুদ্ধ জনতা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের শক্তি উৎসারিত হতে দেখেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব থেকে। শেখ হাসিনার ওপর যত ক্রোধ, তা নিঃসৃত হয়েছিল শেখ মুজিবের মূর্তি ও মুর্যাল ধ্বংসের মাধ্যমে। এখানেও দেখা যায় ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রতীককে জনতা বেছে নিয়েছিল তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে। 

২০২৪-এর ১ জুলাই থেকে আগস্টের ৫ তারিখের মধ্যে ছাত্রদের আন্দোলন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়। অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা করতে মালবাহী বিমানে তার তীর্থ দেশ ভারতে পলায়ন করেন। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে জুলুম-নির্যাতনের এমন কোনো উপায় ছিল না, যা ব্যবহার করা হয়নি। জেল-জুলুম, মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন, গুম, আয়নাঘর ও জঙ্গি নাটক মঞ্চায়নসহ নির্যাতনের এমন কোনো রকম ছিল না, যা শেখ হাসিনার নির্যাতনকারী বাহিনী ব্যবহার করেনি। মনে হয়েছিল নির্যাতন-নিপীড়নের এ অন্ধকার রাতের অবসান হবে না। তারপরও কথা আছে। রাত যত গভীর হয়, প্রভাত ততই ঘনিয়ে আসে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনেও তা-ই হয়েছে। 

পৃথিবীর দেশে দেশে স্বৈরশাসকরা ২০ থেকে ৪০ বছর শাসন করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক স্বৈরশাসককেই চরম অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। তবে দু-একজন স্বৈরশাসকের কথা বলা যায়, যাদেরকে তাদের দেশের জনগণ জাতীয় মর্যাদার প্রতীক বলে মনে করত। সেদেশগুলোতে মার্কিন হস্তক্ষেপে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা শাসকদের বিদায় নিতে হয়েছে। 

কারণ সেই শাসকরা টিকে থাকলে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা হয় না। শেখ হাসিনাও বলতে শুরু করেছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঘাঁটি তৈরি করতে দেননি বলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মার্কিনিরা স্বড়যন্ত্র করছে। তার এই দাবি ধোপে টেকে না। তার সন্তান ও কাছের আত্মীয়রা পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় বসবাস করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সেখানে থেকে তারা পাশ্চাত্যের শাসককুলের সঙ্গে নানাভাবে সখ্য গড়ে তুলতে প্রয়াস পাচ্ছে। 

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবাদ না হওয়ায় অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন, এদেশের তরুণ সমাজ আর অতীতের মতো নেই, তারা বদলে গেছে। তাদের স্বভাব-চরিত্র ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। তারা দেশের কোনো ভবিষ্যৎ দেখে না। তাদের নেশা স্মার্ট ফোনে কিংবা নীল ছবিতে। কিন্তু হঠাৎ করে তারা যখন জেগে উঠল, তখন আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে তা দেখলাম। 

এবারের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মেয়াদ মাত্র ছত্রিশ দিন। এর বিপরীতে ১৯৬৯-এর ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান অব্যাহত ছিল প্রায় তিন মাসজুড়ে। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের শাসনের অবসান হয়। আন্দোলন অভ্যুত্থানের ফসল হিসাবে গণতন্ত্র আসেনি। নির্বাচন হলেও নির্বাচনের ফলাফল বাস্তবায়িত হতে দেয়নি সামরিক শাসক। এবারের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা একটি মুক্ত পরিবেশ পেয়েছি। শেখ হাসিনার শাসন উৎখাত হওয়ার পর গত পাঁচ মাসে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান না এলেও মন খুলে কথা বলতে বা লিখতে কেউ বাধা দেয়নি। 

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, খুবই কম ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ তার আবরণ বদলে আবার ফিরে এসেছে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে অপসারিত হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের অবস্থান রয়ে গেছে। মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ফ্যাসিবাদের সাঙ্গাতরা সাময়িকভাবে কিছুটা নিশ্চুপ হয়ে গেলেও তারা আবারও অঘটন ঘটাতে পারে। তাদের শক্তির উৎস প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নৈতিক ও বস্তুগত সহায়তা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার হুংকারও কোনো কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি উচ্চারণ করছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আগ্রাসন ও ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।

ফ্যাসিবাদ কেন এদেশের মাটিতে শিকড় গাড়তে পারল? এর কারণ গভীরভাবে অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। এদেশে ফ্যাসিবাদীরা একটি রাজনৈতিক বয়ান সৃষ্টি করতে সফল হয়েছে। এ বয়ানের বৈশিষ্ট্য হলো মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার অথবা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বাইনারি। 

এ বয়ানের মাধ্যমে জাতিকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের মনে এ বয়ানের বিপরীতে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় মর্যাদাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে নতুন বয়ান সৃষ্টি করতে হবে এবং তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। মোদ্দা কথায় বলা যায়, ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের কবর দিতে না পারলে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। আর ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার যুদ্ধে হাতিয়ার হবে নতুন বয়ানের বাণ।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে পুরোনো ধারার ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, যদিও তারা এ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছে এবং প্রাণ দিয়েছে। এর কারণ সম্ভাবত এই যে, সাধারণ ছাত্র-জনতা তাদের প্রতি আস্থা ধারণ করতে পারেনি। সেজন্যই প্রয়োজন ছিল নতুন নেতৃত্বের মুখ, ভিন্নধর্মী সাংগঠনিক কাঠামো এবং জনগণের হৃদয়ে পৌঁছানোর ভিন্ন ধরনের ভাষা এবং অংশত কিছু নতুন বয়ান। 

যেমন-আন্দোলনের ভাষা হিসাবে ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ টু ঢাকা প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার। এবার ছাত্র-তরুণরা স্বাধীনতার বয়ান সৃষ্টি করতে গিয়ে ’৭১-এর পাশাপাশি ’৪৭-কেও এনেছে। কারণ ’৪৭ ছাড়া বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। শুধু তাই নয়, এ তরুণরা জাতির চৌহদ্দি হিসাবে নতুন ভূগোলের কথা বলেছে। তবে সেটা কত বাস্তবসম্মত তা এক ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

এবারের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে আত্মবলিদানের উৎসবের সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্র-জনতা পুষ্পমাল্যের মতো বুলেটকে বুকে ধারণ করেছে। মিছিলে পাশের সঙ্গীর মৃত্যু অন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত করতে পারেনি, বরং তারা এগিয়ে গেছে নির্ভয়ে, দুঃসাহসে। এত মৃত্যু, এত রক্ত অতীতের কোনো গণ-অভ্যুত্থানে দেখা যায়নি। 

এমনকি ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানেও নয়। তাই ৩৬ দিনের আন্দোলনে দানবতুল্য ফ্যাসিবাদের জননীকে বিতাড়ন করা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে সাময়িকভাবে ফ্যাসিবাদের ভবনগুলো দখলে নেওয়া। গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে ছাত্র-জনতার আত্মাহুতির বিবরণ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দেখে দেখে একটি গান আমাকে অশ্রুসিক্ত করেছে। গানের প্রথম দুটি ছত্র হলো-মুক্তির মন্দির সোপান তলে/কত প্রাণ হলো বলিদান/লেখা আছে অশ্রুজলে। আরও ভাবতে চাই, বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা/এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা। 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম