
প্রিন্ট: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫৬ এএম

মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০১৮, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চার শর্তে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা স্থাপন, স্বীকৃতি, পরিচালনা, জনবল কাঠামো এবং বেতন-ভাতাদি সংক্রান্ত নীতিমালার ছাড়পত্র দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নীতিমালায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের সম্মানী ২৪০ শতাংশ এবং সহকারী শিক্ষকদের ২১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তবে যত্রতত্র গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে।
মহানগর এলাকায় এক কিলোমিটার, শহর বা পৌর এলাকায় দেড় কিলোমিটার এবং মফস্বল এলাকায় দুই কিলোমিটারের মধ্যে একাধিক মাদ্রাসা থাকলে একটি আরেকটির মধ্যে একীভূত করা হবে। সেপ্টেম্বরে এ নীতিমালা অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী।
নীতিমালায় অর্থ মন্ত্রণালয় আরোপিত শর্তগুলো হল- জনবল কাঠামো যাই থাকুক না কেন একবারে ব্যয় বাড়ানো যাবে না; বাজেটের ভারসাম্যের দিকে নজর রেখে পর্যায়ক্রমে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে; শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাক্রম অনুযায়ী নিয়োগ করতে হবে; ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে একাধিক মাদ্রাসা থাকলে একটির সঙ্গে আরেকটি একীভূত করতে প্রশাসনিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তবে, নীতিমালায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি নেই। সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এসব মাদ্রাসার শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষায় উন্নয়নের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোর উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছে। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নীতিমালা করা হয়েছে। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া গেছে। এখন এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে তিন হাজার ৪৩৩টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার ২৪৩ জন শিক্ষক কর্মরত। প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষার অন্য ধারার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ইবতেদায়ি পর্যায়েও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, আইসিটির
মতো বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়গুলো পড়ানো হয়।
দেশে দু’ধরনের ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে। একটি দাখিল বা এর উচ্চতর মাদ্রাসার সঙ্গে সংযুক্ত, আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র। বর্তমানে এমপিওভুক্ত সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা নির্ধারিত হারে বেতন ভাতাদি পেয়ে আসছেন। ওইসব মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকরা মাসে ১০ হাজার ৩৮৮ টাকা এবং সহকারী শিক্ষকরা মাসে ৯ হাজার ৯৮৮ টাকা হারে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। অপরদিকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ১৫ হাজার ২৪৩ জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র চার হাজার ৫২৯ জন সরকারি শিক্ষা সহায়তা অনুদান পাচ্ছেন।
প্রধান শিক্ষক দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং জুনিয়র শিক্ষক ও কারি দুই হাজার ৩০০ টাকা করে পাচ্ছেন। অবশ্য এ সরকারের শুরুতে এ ধরনের মাদ্রাসার শিক্ষকরা ৫০০ টাকা করে অনুদান পেতেন। কয়েক দফায় উন্নীত করে এখন উল্লিখিত হারে অনুদান দেয়া হচ্ছে। এরপরও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নীতিমালা তৈরি করা, প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ আট দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা) রওনক মাহমুদের নেতৃত্বে একটি কমিটিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটির খসড়া নীতিমালায় অনুমোদন দেন শিক্ষামন্ত্রী। এরপর অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। নীতিমালায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিগত অনুমোদন নিয়ে পুনরায় প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়। এরপরই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতিগত অনুমোদনের জন্য নীতিমালাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
কী আছে নীতিমালায় : নীতিমালা অনুযায়ী মাদ্রাসা স্থাপনে অনুমোদন দেয়ার কাজ করবে মাদ্রাসা বোর্ড। তবে যে কোনো অনুমোদন দেয়ার আগে বোর্ডকে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। ব্যক্তির নামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা যাবে; কিন্তু যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা যাবে না। আগে মাদ্রাসার নামে জমি রেজিস্ট্রি করতে হবে। এরপর জমির সেই দলিলসহ মাদ্রাসা স্থাপনের আবেদন করতে হবে।
বছরের প্রথম তিন মাস শুধু আবেদন নেয়া হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামে স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে ২০ হাজার টাকা গচ্ছিত থাকার প্রমাণপত্র দিতে হবে। প্রস্তাবিত মাদ্রাসার নামে মফস্বল এলাকার শূন্য দশমিক ৩৩ একর জমি থাকতে হবে। শহর বা পৌর এলাকায় শূন্য দশমিক ২০ একর ও মহানগর এলাকায় শূন্য দশমিক ১০ একর জমি থাকতে হবে। মাদ্রাসার নামে রেজিস্ট্রি করা জমির নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের হালনাগাদ দাখিলা থাকতে হবে।
নীতিমালায় মাদ্রাসার ভবনের ব্যাপারে আটটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ন্যূনপক্ষে টিনের বেড়াসহ টিনশেড ঘর থাকতে হবে। শিক্ষকের বসার জন্য একটি কক্ষ এবং পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ থাকতে হবে। শ্রেণীকক্ষের আয়তন হবে মফস্বলে দেড় হাজার এবং মহানগর, পৌর ও শহর এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের। শিক্ষকের কক্ষের আয়তন হবে দেড়শ’ বর্গফুটের। বসার জন্য পর্যাপ্ত আসবাবপত্র, মানসম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে পর্যায়ক্রমে সংযোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ ও পাঠাগার থাকতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়, দুই মাদ্রাসার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে মহানগর এলাকায় এক কিলোমিটার, শহর বা পৌর এলাকায় দেড় কিলোমিটার এবং মফস্বল এলাকায় দুই কিলোমিটার থাকতে হবে। এতে আরও বলা হয়, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বা জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত সিলেবাস বা পাঠ্যপুস্তক পাঠদান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা মেনে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। মহানগর, পৌর ও শহর এলাকার মাদ্রাসায় কমপক্ষে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এর মধ্যে প্রতি শ্রেণীতে কমপক্ষে ২০ জন থাকতে হবে।
মফস্বল এলাকার প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম ১৫০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এর মধ্যে ক্লাসপ্রতি ১৫ জন থাকতে হবে। তবে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এলাকার ক্ষেত্রে এ শর্ত শিথিল করা হয়েছে। ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় মহানগর, পৌর ও শহর এলাকার প্রতিষ্ঠান থেকে ন্যূনতম ২০ শিক্ষার্থী অংশ নিতে হবে। তাদের মধ্যে ১৫ জনকে পাস করতে হবে। গ্রাম এলাকায় সমাপনী পরীক্ষায় ১৫ শিক্ষার্থীকে অংশ নিতে হবে। তাদের মধ্যে ১০ জনকে পাস করতে হবে। ইবতেদায়ি মাদ্রাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে প্রতিটি উপজেলা বা থানায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিটি থাকবে। মাদ্রাসা পরিচালনায় কাজ করবে ব্যবস্থাপনা বা সাংগঠনিক কমিটি। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে নিয়োগ দেবেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তবে অন্য শিক্ষক ও কর্মচারীকে নিয়োগ দেবেন প্রধান শিক্ষক। উভয় ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিটি শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের তালিকা চূড়ান্ত করবে।